হিন্দু উত্তরাধিকার আইন

আজকের আলোচনার বিষয়ঃ হিন্দু উত্তরাধিকার আইন

হিন্দু উত্তরাধিকার আইন
হিন্দু উত্তরাধিকার আইন

 

হিন্দু উত্তরাধিকার আইন

হিন্দু আইন হিন্দুদের ব্যক্তিগত ও সনাতনী ধর্ম। এ আইনের মৌলিক ভিত্তি হল বেদ। উত্তরাধিকার, বিবাহ, অভিভাবকত্ব, উইল, বণ্টন, দান ইত্যাদি এ আইন দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। হিন্দু আইনের উৎস চারটি (১) বেন বা শ্রুতি (২) স্মৃতি (৩) ব্যাখ্যা বা নিবন্ধ (৪) প্রথা। এছাড়া হিন্দু আইনের তিনটি আধুনিক উৎস রয়েছে। যথা (১) আদালতের সিদ্ধান্ত বা নজির (২) বিধিবদ্ধ আইন (৩) সুবিচার / ন্যায়পরায়ণতা।

উত্তরাধিকার

হিন্দু আইনে দু’প্রকার উত্তরাধিকার পদ্ধতি চালু আছে (১) মিতাক্ষরা (২) দায়ভাগ পদ্ধতি। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুগণ দায়ভাগ মতবাদের অনুসারী। অন্যান্য অঞ্চলের হিন্দুগণ মিতাক্ষরা মতবাদের অনুসারী। তাই এখানে শুধু দায়ভাগ মতবাদ নিয়েই আলোচনা করা হল :

দায়ভাগঃ 

দায়ভাগ অনুসারে মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির অধিকার তার ওয়ারিশগণ উত্তরাধিকার হিসেবে প্রাপ্ত হয়। পিণ্ড দানই হচ্ছে উত্তরাধিকার নির্ণয়ের ভিত্তি। দায়ভাগ মতে হিন্দু উত্তরাধিকার তিন প্রকার (১) সপিণ্ড (২) সকূল্য ও (৩) সমানোদক।

সপিন্ডঃ

 দায়ভাগ মতে সপিণ্ড হলো সবচেয়ে নিকটবর্তী উত্তরাধিকারী। যে সব ব্যক্তি সপিন্ড শ্রেণীভুক্ত তারা হলঃ

(ক) পিতৃকূলে ঊর্ধ্বতন ও পুরুষ ও মাতৃকূলে উর্দ্ধাতন ৩ পুরুষ = ৬ জন । 

(খ) পুত্রের দিকের নিম্নবর্তী ও পুরুষ ও দৌহিত্র জাতীয়দের নিম্নবর্তী ও পুরুষ = ৬

(গ) উল্লিখিত ১২ জন ছাড়াও পিণ্ড দানের অধিকারী আরও আছে ৩৬ জন। 

(ঘ) এ ছাড়াও বিশেষ নিয়মে বিধবা, কন্যা, মাতা, পিতামহী ও প্রপিতামহী এ ৫ জন মহিলাসহ ৫৩ জন ।

 

হিন্দু উত্তরাধিকার আইন
হিন্দু উত্তরাধিকার আইন

 

সকূলঃ 

এরা সপিণ্ডের পরবর্তী সারির উত্তরাধিকারী। এরা হলো প্রপিতামহের উর্দ্ধতন পুরুষ। সপিদের অবর্তমানে এরা উত্তরাধিকারী হয়।

সমানোদকঃ 

এরা তৃতীয় শ্রেণীর ও দূরবর্তী উত্তরাধিকারী। সকূল্যের ঊর্ধ্বতন সাত পুরুষ সমানোদক হিসাবে অভিহিত। এরা সকলেই পুরুষ এদের সংখ্যা ১৪৭ জন । বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে সপিগুদের কেউ বেঁচে থাকলে সকূল্য ও সমানোদকদের কেউ সম্পত্তি পাবে না। এরূপেই এ তিন শ্রেণীর উত্তরাধিকারীদের অধিকার ক্রমান্বয়ে আসবে।

সম্পত্তি হতে বঞ্চিতঃ 

যে সব কারণে একজন হিন্দু উত্তরাধিকত্ব হতে বঞ্চিত হয়।

(ক) অসতী হলে,

(খ) ধর্মান্তরিত (কেবল বাংলাদেশে প্রযোজ্য); ভারতে “ধর্মীয় স্বাধীনতা আইন, ১৮৫০” The Caste Disabilities Act (Act XXI of 1850) মূলে ধর্মান্তরের জন্য সম্পত্তি হতে কেউ বঞ্চিত হয় না,

(গ) শারীরিক ও মানসিক অসমর্থতা (মিতাক্ষরা অনুসারীদের মধ্যে),

(ঘ) সহজাত পাগল ও হাবা ছাড়া অন্য অসমর্থরা সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে না, 

(ঙ) হত্যাকারীঃ হত্যাকারী নিজে বা কারো মাধ্যমে হত্যাকাণ্ড ঘটালে হত ব্যক্তির সম্পত্তি থেকে সে বঞ্চিত হবে,

(চ) পাপাসক্ততাঃ পাপাসক্ত ব্যক্তি বঞ্চিত হবে, তবে প্রায়শ্চিত্তের পর সম্পত্তি পাবে,

(ছ) সন্ন্যাসীঃ কোন হিন্দু সন্ন্যাসী হলে তাকে মৃত গণ্য করা হয় এবং তিনি সম্পত্তি পান না। যে সকল অযোগ্যতার জন্য কোন হিন্দু সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন ঐ সকল যোগ্যতার অবসান সম্পত্তি বন্টনকালে হলে তিনি সম্পত্তি পাবেন।

স্ত্রী ধনঃ

স্ত্রী ধন অর্থ নারীর সম্পদ। মহামুণি মজুর মতে বিবাহযজ্ঞের পূর্বে কণেকে যা দেয়া হয় (বিবাহের সময়) তাই স্ত্রী ধন। দায়ভাগ আইনের রচয়িতা জীমুতিবাহন এর মতে ‘স্ত্রী ধন হলো নারীর একান্ত নিজস্ব সম্পত্তি, যাতে তার স্বামীরও কোন কর্তৃত্ব নেই।

 

হিন্দু উত্তরাধিকার আইন
হিন্দু উত্তরাধিকার আইন

 

স্ত্রী ধনের উত্তরাধিকারঃ

(ক) অবিবাহিতা কন্যা স্ত্রী ধন রেখে মারা গেলে তার উত্তরাধিকার হবে 

(১) সহোদর ভাই (২) মাত্রা (৩) পিতা (৪) পিতার নিকটতম উত্তরাধিকারী।

(খ) কোন বিবাহিতা মহিলা স্ত্রী ধন রেখে মারা গেলে তার রেখে যাওয়া সম্পত্তি চার ভাগে বিভক্ত হয়। যথা— 

১। শুল্কঃ

(স্বামী গৃহে যাওয়ার সময় যে উপহার দেয়া হয়েছিল) এর উত্তরাধিকারী (ক) সহোদর ভাই (খ) মাতা (গ) পিতা (ঘ) স্বামী ।

২। যৌতুকঃ 

(আত্মীয়স্বজন কর্তৃক বিবাহের সময় দেয় উপহার) এর উত্তরাধিকারী হবেন।

(ক) কুমারী কন্যা (খ) বাগদত্তা কন্যা (গ) পুত্রবর্তী বিবাহিতা কন্যা (ঘ) বিবাহিতা বন্ধ্যা/বিধকা কন্যা (3) পুত্র (চ) কন্যার পুত্র (ছ) পুত্রের পুত্র (জ) পুত্রের পৌত্র (ঝ) সৎপুত্র (এ) সৎ পুত্রের পুত্র (ট) সংপুরের পৌত্রা।

৩। অনুধেয়কঃ

(বিবাহকালে পিতার নিকট হতে প্রাপ্ত উপহার) এ ধরনের সম্পদ ‘যৌতুক’ স্ত্রী ধনের ন্যায় বণ্টিত হবে, তবে পুরুষগণ বিবাহিতা কন্যার পূর্বে পাৰে।

৪। অযৌতুকঃ

(বিবাহের পূর্বে বা পরে প্রাপ্ত যাবতীয় সম্পত্তি) এর উত্তরাধিকারী হবেন।

(ক) পুত্র এবং কুমারী কন্যা (সমান) (খ) পুত্রবর্তী কন্যা (গ) পৌত্র (ঘ) দৌহিত্র (ঙ) বিবাহিতা বন্ধ্যা/বিধবা কন্যা (চ) সহোদর ভাই (ছ) মাতা (জ) পিতা এবং (ঝ) স্বামী।

 

হিন্দু উত্তরাধিকার আইন
হিন্দু উত্তরাধিকার আইন

 

উত্তরাধিকার এর হিস্যা বণ্টন পদ্ধতিঃ

(১) পুত্র পিতার সমগ্র সম্পত্তির একক উত্তরাধিকারী

(২) পুত্র একাধিক হলে সমান হারে সম্পত্তি পাবে। 

(৩) পুত্র মারা গিয়ে থাকলে পৌত্র উত্তরাধিকারী হবে (পিতার অংশ পাবে)।

(৪) বিধবা স্ত্রী এক পুত্রের সমান অংশ ‘জীবন স্বত্ব পাবে। (সম্পত্তিতে হিন্দু নারীদের অধিকার আইনের ৩(১) ধারা)।

(৫) একাধিক বিধবা স্ত্রী থাকলে সকলে একত্রে এক পুত্রের সমান সম্পত্তি পাবে। 

(৬) মৃতের বিধবা পুত্রবধূ/প্রপৌত্রবধূ থাকলে সে এক পুত্রের সমান ‘জীবন স্বত্ত্ব’ পাবে (কৃষি জমি ব্যতীত)। 

(৭) উপরে বর্ণিত ১-৬ নং ক্রমিকের কোন উত্তরাধিকারী না থাকলে কন্যা পিতার সম্পত্তি পাবে। 

(৮) কন্যাদের মধ্যে ‘কুমারী কন্যার’ দাবি প্রথম এবং সে-ই সব সম্পত্তি পাবে।

(৯) কুমারী কন্যা না থাকলে পুত্রবর্তী কন্যা উত্তরাধিকারী হবে।

(১০) বন্ধ্যাকন্যা, বিধবা কন্যা, সন্তানহীন কন্যা এবং যে সব কন্যার শুধু কন্যা সন্তান আছে তারা উত্তরাধিকারী হবে না। তবে এরূপ কন্যাদের মধ্যে যে, কোন দত্তকপুত্র গ্রহণ করেছে সে বঞ্চিত হবে না।

(১১) এরপর ক্রমানুসারে উত্তরাধিকারী হিসেবে সম্পত্তি পাবে (ক) দৌহিত্র (খ) পিতা (গ) ভাই (প্রথমে সহোদর পরে বৈমাত্রেয় ভাই) (ঘ) মাতা (ঙ) ভ্রাতুষ্পুত্র (চ) ভাতুষ্পুত্রের পুত্র (ছ) ভাগিনেয় (জ) পিতামহ এবং (ঝ) পিতামহী এভাবে ৫৩ জন।

(১২) মূলত প্রথম বিশ জনের মধ্যেই উত্তরাধিকারীত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে। 

(১৩) হিন্দু আইনে ত্যাজ্য করে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার কোন বিধান নেই ।

(১৪) মৃতের হত্যাকারী পুত্র এবং হত্যাকারী পুত্রের পুত্র সম্পত্তি পাবে না। 

(১৫) সপিণ্ডের তালিকায় বোন এর নাম না থাকায় বোন উত্তরাধিকারী হবে না। 

(১৬) হিন্দু আইন শুধু ভারত উপমহাদেশের হিন্দুদের জন্য প্রযোজ্য। 

(১৭) দান দায়ভাগ মতে একজন হিন্দু যাদের ভরণ-পোষণের জন্য আইনত বাধ্য তাদের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা রেখে সমুদয় সম্পত্তি দান করতে পারেন। 

(১৮) দায়ভাগ মতে পিতার মৃত্যুতে পুত্র সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারীত্ব লাভ করে। 

(১৯) উইল দানের মতই যাদের ভরণ-পোষণের বাধ্যবাধকতা আছে তাদের জন্য ব্যবস্থা রেখে একজন হিন্দু তার বাকি সম্পত্তি অপরকে উইল করতে পারেন।

(২০) ভরণ-পোষণ একজন হিন্দু তার বৃদ্ধ পিতা-মাতা, সতী স্ত্রী, নাবালক সন্তান, অবিবাহিতা কন্যার ভরণ-পোষণে বাধ্য ।

 

google news logo
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

কতিপয় উদাহরণ :

১। ওয়ারিশ = পুত্র + পৌত্র + স্ত্ৰী

                 = (১/৩) + (১/৩) + (১/৩)

২। ওয়ারিশ = পুত্র + মৃত পুত্রের ছেলে + বিধবা পুত্রবধূ

                 = (১/৩) + (১/৩) + (১/৩)

৩। ওয়ারিশ = স্ত্ৰী + পুত্র + কন্যা

                = (১/২) + (১/২) + ০ (স্ত্রী জীবন স্বত্ব হিসেবে পেয়েছে)

৪। ওয়ারিশ = পুত্র (কুষ্ঠ রোগগ্রস্ত) + পুত্র

               = (১/২) + (১/২) (মিতাক্ষরা মতবাদ অনুসারে) 

৫। ওয়ারিশ = পুত্র (কুষ্ঠ রোগগ্রস্ত) = পুত্র

                 = ০ + ১ (দায়ভাগ মতবাদ অনুসারে)

৬। ওয়ারিশ = স্ত্রী (অসতী) + পিতা

                 = ০ + ১

৭। ওয়ারিশ = পুত্র (ধর্মান্তরিত) + পুত্র

                 = ০ + ১(কেবল বাংলাদেশে) 

৮। ওয়ারিশ = পুত্র (ধর্মান্তরিত) + পুত্র

                = (১/২) + (১/২) (ভারতে ১৮৫০ সনের আইনের পর)

৯ । ওয়ারিশ = পুত্র (সন্যাসী) + ভাই

                 = ০ + ১

১০। ওয়ারিশ = পৌত্র (সন্ন্যাসী) + কুমারী কন্যা + পুত্রবর্তী কন্যা

                 = ০ + ১ (জীবন স্বত্ত্ব) + ০

১১। ওয়ারিশ = পুত্র (জন্মান্ধ) + ভাই

               =  ০ + ১ (জন্মান্ধের সন্তান থাকলে ওয়ারিশ হবে) )

১২। ওয়ারিশ = কুমারী কন্যা + বিবাহিতা পুত্রবর্তী কন্যা + বন্ধ্যা কন্যা + মাতা

                   =১ (জীবনস্বত্ত্ব) + ০ + ০ + ০

১৩। ওয়ারিশ = পুত্র + পুত্রবধূ + প্রপৌত্রবধূ + স্ত্রী

                   = (১/২) + (১/৬) + (১/৬) + (১/৬) (শেষ তিনজন জীবন স্বত্বে)

১৪। ওয়ারিশ = ২ স্ত্রী + পুত্র + পুত্র + পুত্র + পুত্র

                   = (১/৫) + (১/৫) + (১/৫) + (১/৫) + (১/৫)

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment