ওয়াক্ফ কেন, কিভাবে করবেন

আজকে  আমরা আলোচনা করবো ওয়াক্ফ কেন, কিভাবে করবেন

 

ওয়াক্ফ কেন, কিভাবে করবেন
ওয়াক্ফ কেন, কিভাবে করবেন

 

ওয়াক্ফ কেন, কিভাবে করবেন

সরকার ওয়াক্ফ সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যে ১৯৬২ সালে ওয়াক্ফ অধ্যাদেশ, ১৯৬২ জারী করে।

ওয়াকৃষ্ণ বলতে অধ্যাদেশের ২ ধারায় বলা হয়েছে যে, ‘কোন মুসলমান কর্তৃক ধর্মীয়, পবিত্র বা দাতব্য কাজের উদ্দেশ্যে তার স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি স্থায়ীভাবে উৎসর্গ করাকে বুঝায়।’ তবে কোন অমুসলিমও একই উদ্দেশ্যে সম্পত্তি উৎসর্গ করতে পারেন।

ওয়াকফঃ

যিনি সম্পত্তি উৎসর্গ করে তাকে বলে ‘ওয়াকফ’।

ওয়াক্ফ দুই প্রকারঃ

(১) ওয়াকফ লিল্লাহ এবং

(২) ওয়াক্ফ আল-আওলাদ।

ওয়াক্ফ লিল্লাহ :

ধর্মীয় বা দাতব্য উদ্দেশ্যে অর্থাৎ পরকালে শান্তির আশায় পুণ্য অর্জন এবং ইহকালে জনগণের কল্যাণের লক্ষ্যে যে ওয়াক্ফ করা হয় তাকে বলে “ওয়াকফ লিল্লাহ’।

ওয়াকফ আল-আওলাদঃ

কোন ব্যক্তি তার সম্পত্তি ওয়াকফ করে এর আয় হতে আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে তার বংশধরদের/পরিবারের সদস্যদের এমনকি তার নিজের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করতে পারেন। এরূপ ওয়াক্ফই হলো ‘ওয়াক্ফ আল- আওলাদ’। ওয়াকিফ যদি সম্পূর্ণ সম্পত্তি এরূপ ভরণ-পোষণের লক্ষ্যে উৎসর্গ করে, তবে ওয়াকিফ বা তার বংশধরগণ নিশ্চিহ্ন না হওয়া পর্যন্ত ওয়াকফ সম্পত্তি দাতব্য/ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত হবে না। তাদের মৃত্যুর পর ওয়াক্ফ সম্পত্তির আয় দাতব্য বা ধর্মীয় কাজে ব্যয়িত হবে। আর আংশিক ধর্মীয়/দাতব্য এবং আংশিক ভরণ-পোষণ এর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে ওয়াকফ করলে ওয়াক্ফকৃত সম্পত্তির আয় সেভাবেই ব্যয়িত হবে।

 

ওয়াক্ফ কেন, কিভাবে করবেন
ওয়াক্ফ কেন, কিভাবে করবেন

 

যে সব উদ্দেশ্যে ওয়াক্ফ করা যায়ঃ

মক্কা শরীফে হাজীদের জন্য ‘বোরাত’ (বোর্ডিং হাউজ) নির্মাণ, ঈদগাহে মঞ্জুরী দান, মাদ্রাসা, খানকা নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, মসজিদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এর ব্যয় নির্বাহ, হজ্জ পালনে সাহায্য করা, গরীবদের সাহায্য করা। ওয়াকিফ ও তার বংশধরদের ভরণ- পোষণ ইত্যাদি উদ্দেশ্যে সম্পত্তি উৎসর্গ করা যায়।

ওয়াফের উপাদান

(ক) ওয়াকফের উদ্দেশ্যে সম্পত্তি উৎসর্গ করতে হবে,

(খ) ওয়াকফ ধর্মীয় বা দাতব্য উদ্দেশ্যে হতে হবে,

(গ) ওয়াফের উদ্দেশ্যে সম্পত্তি উৎসর্গ অবশ্যই চিরস্থায়ী হতে হবে;

(ঘ) ওয়াকিফকে উৎসর্গীকৃত সম্পত্তির বৈধ মালিক হতে হবে;

(ঙ) ওয়াকিফকে প্রাপ্তবয়স্ক এবং সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন হতে হবে;

(চ) ওয়াকফ শর্তমুক্ত হতে হবে।

ওয়াফের বিষয়বস্তুঃ

স্থাবর বা অস্থাবর উভয় ধরনের সম্পত্তিই ওয়াকফ করা যায়। অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে কোম্পানীর শেয়ার, সরকারী ঋণপত্র, নগদ অর্থ ইত্যাদি। ওয়াকফ প্রশাসক সরকার ওয়াক্ফকৃত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে অধ্যাদেশের ৭ ধারা অনুসারে ‘ওয়াক্ফ প্রশাসক নিয়োগ করে থাকেন। যিনি ওয়াকফ সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করে থাকেন।

ওয়াক্ফ প্রশাসকের দায়িত্ব ও কর্তব্যঃ

(ক) ওয়াক্ফ প্রশাসক ওয়াকফ ও এর তহবিল পরিচালনার জন্য ১০ সদস্য বিশিষ্ট। একটি কমিটি গঠন করেন। তিনি কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। (ধারা- ১৯, ২০)

(খ) প্রশাসক সরকারের অনুমতিক্রমে এবং ওয়াফের কল্যাণে/উন্নতিকল্পে ওয়াকফকৃত সম্পত্তি বা এর অংশবিশেষ যে কোন রূপ হস্তান্তর করতে পারেন। (ধারা- (৩৩)

(গ) প্রশাসক মোতায়াল্লীকে উপযুক্ত কারণ সাপেক্ষে অপসারণ করতে পারেন ।(ধারা-৩২)

(ঘ) প্রশাসক তার প্রতিনিধির মাধ্যমে বা সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে তার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। (ধারা-৩৪ ও ৩৬) (বাস্তবে জেলাপ্রশাসকই ওয়াক্ফ প্রশাসকের পক্ষে দায়িত্ব পালন করে থাকেন ।

(ঙ) ওয়াকফ প্রশাসকের কোন আদেশে কেউ সংক্ষুব্ধ (ক্ষতিগ্রস্ত) হলে তিনি সংশ্লিষ্ট জেলা জজের আদালতে আপিল করতে পারেন । (ধারা-৩৫)

মোতায়াল্লী নিয়োগ

ওয়াকফ পরিচালনার জন্য গঠিত কমিটির সদস্য সচিবের বা ব্যবস্থাপনার জন্য ব্যবস্থাপকের ভূমিকায় যিনি থাকেন তাকেই বলে মোতায়াল্লী। মোতায়াল্লী সাবালক ও মানসিকভাবে সুস্থ হবেন।

 

ওয়াক্ফ কেন, কিভাবে করবেন
ওয়াক্ফ কেন, কিভাবে করবেন

 

মোতায়াল্লী নিয়োগ প্রক্রিয়া নিম্নরূপ :

(১) ওয়াকিফ নিজে মোতায়াল্লী হতে পারেন।

(২) ওয়াকিফ সম্পত্তির সুবিধাভোগী (Beneficiary) ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক মনোনীত হতে পারেন।

(৩) ওয়াকিফের মৃত্যুকালীন ঘোষণা দ্বারাও কোন ব্যক্তি মোতায়ারী হতে পারেন।

(৪) ওয়াকিফের কার্যকারক (Executor) কর্তৃক মনোনীত হতে পারেন।

(৫) আধ্যাত্মিক কার্যক্রম না থাকলে মহিলাও মোতায়ারী নিযুক্ত হতে পারেন।

(৬) প্রশাসক মোতায়ারী নিয়োগ করতে পারেন, তবে এ মোতায়ারী নিয়ে কোন সমস্যা হলে এবং এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কোন পক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত ও (দেওয়ানী) মোজায়ারী নিয়োগ দিতে পারেন। (ধারা-৩৪)

মোতায়াল্লীর দায়িত্ব ও কর্তব্য

(১) ওয়াক্ফ সম্পত্তি ‘প্রশাসকের দপ্তরে (ঢাকার ইস্কাটনে) তালিকাভুক্ত করা।

(২) প্রতি ১৫ই জুলাই তারিখের মধ্যে পূর্ববর্তী অর্থ বছরের আয় ও বায়ের হিসেব প্রশাসকের নিকট পেশ করা।

(৩) আয়-ব্যয়ের নিরীক্ষার (Audit) ব্যবস্থা করা।

(৪) ওয়াক্ফ সম্পত্তি হস্তান্তর করার প্রয়োজন হলে প্রশাসকের পূর্বানুমতি নেয়া।

(৫) ওয়াক্ফ সম্পত্তির আয়ের ৫% বার্ষিক চাঁদা প্রশাসকের দপ্তরে প্রদান করা।

(৬) ওয়াক্ফনামায় উল্লিখিত উদ্দেশ্যাবলী যথাযথভাবে পালনে মোতায়ালী আইনত বাধ্য ।

ওয়াক্ফ রেজিস্ট্রেশনঃ

সম্পত্তি হস্তান্তর আইন, ১৮৮২ এর বিধান মতে স্থাবর সম্পত্তির (১০০ টাকার বেশি মূল্য হলেই) দলিল রেজিস্ট্রি বাধ্যতামূলক। তবে অস্থাবর সম্পত্তির ওয়াক্ফ মৌখিকভাবেও করা যায়।

ওয়াক্ফ প্রত্যাহার :

অছিয়তের (উইল) মাধ্যমে ওয়াকফ সৃষ্টি হয়ে থাকলে ওয়াকিফ তার মৃত্যুর পূর্বে যে কোন সময় তা প্রত্যাহার করতে পারেন। অছিয়ত ভিন্ন সাধারণ ওয়াফের ক্ষেত্রে ওয়াকিফ ওয়াক্ফ প্রত্যাহার কতে পারেন না।

ওয়াকফ করা বাধ্যতামূলকঃ

মোহামেডানস্ ল অনুসারে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে ঈদগাহ, কবরস্থান, ইমামবাড়া, মাদ্রাসা ও মসজিদের জন্য জমি দান করলে তা অবশ্যই ওয়াক্ফ করতে হবে।

ওয়াক্ফ সম্পত্তি হস্তান্তরঃ

মসজিদ, মাদ্রাসার নামে অনেকেই জমি দান করেন। এ সকল জমি অনেক সময় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি বিভিন্ন কারণে বিক্রি করে থাকেন। বাস্তবে ওয়াকফ সম্পত্তি বিক্রি করতে হলে ওয়াক্ফ প্রশাসকের অনুমতি নিতে হবে। অন্যথায় ঐ বিক্রি শুদ্ধ হবে না এবং তাতে ক্রেতার স্বত্ব সৃষ্টি হবে না। কারণ ওয়াকফ সম্পত্তির মালিক ওয়াক্ফ প্রশাসক। বিবেচ্য জমি মসজিদ-মাদ্রাসার রবর্তী হওয়ার কারণে ঐ জমি বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানের নিকটবর্তী কোন জমি কেনার জন্য ওয়াকফ প্রশাসক এরূপ বেচা-কেনার অনুমতি দিয়ে থাকেন।

 

google news logo
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

কমিটি নিয়ে মতবিরোধে করণীয়ঃ

সম্পত্তি কোন প্রতিষ্ঠানের বরাবরে ওয়াকফ করা হলেও প্রায়ই তা ওয়াকফ প্রশাসকের দপ্তরে তালিকাভুক্ত করা হয় না। তাছাড়া এসকল সম্পত্তির পরিচালনা কমিটি গঠন নিয়েও অনেক সময় দেখা দেয় দ্বন্দ্ব ও বিরোধ। এ ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে যে পক্ষ বিবেচ্য সম্পত্তি ওয়াক্ফ প্রশাসকের দপ্তরে তালিকাভুক্তির জন্য আগে যাবে সে পক্ষ ওয়াক্ফ প্রশাসক কর্তৃক কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে। আর পূর্বেই তালিকাভুক্ত করা হয়েছে এমন ওয়াকফ সম্পত্তি/প্রতিষ্ঠানের বিরোধের নিষ্পত্তি প্রশাসকই করে থাকেন।

তালিকাভুক্তির আবেদন

যে কেউ ওয়াক্ফ সম্পত্তি তালিকাভুক্তির জন্য ওয়াক্ফ অধ্যাদেশের ৪৭ ধারা মতে নির্ধারিত ফরমে ওয়াক্ফ প্রশাসকের বরাবরে আবেদন করতে পারে। অনেক প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে মাজার লাভজনক হওয়ার কারণে তার তালিকাভুক্তি এড়ানোর প্রবণতা লক্ষ করা যায় । এরূপ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে যে কেউ তালিকাভুক্তির আবেদন করতে পারে।

ব্যবহার ভিত্তিতে ওয়াক্ফ

অনেক সময় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা মাজারের জমিদাতা হয়ত ওয়াক্ফ করে দিয়ে যাননি কিন্তু ওয়াক্ফ আইন অনুযায়ী দীর্ঘকাল ব্যবহারের ভিত্তিতে ঐ সম্পত্তি ওয়াফ সম্পত্তিতে পরিণত হয়ে থাকে। এরূপ সম্পত্তি আর নতুন করে রেজিস্ট্রির প্রয়োজন হয়। না, কেবল ওয়াক্ফ প্রশাসকের দপ্তরে তালিকাভুক্ত করতে হয় ।

দেবোত্তর সম্পত্তি

হিন্দু ধর্মাবলম্বী লোকজন মন্দিরের দেবতার উদ্দেশে পুণ্য অর্জনের লক্ষ্যে সম্পত্তি উৎসর্গ করলে তাকে বলে দেবোত্তর সম্পত্তি। দেবোত্তর সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ককে বলে ‘সেবাইত’। সেবাইত এরূপ সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারেন না।

দেবোত্তর সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ :

দেবোত্তর সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয়ে একটি ‘দেবোত্তর সম্পত্তি সেল’ গঠন করা হয়েছে। উক্ত সেল থেকে এরূপ সম্পত্তির সার্বিক তত্ত্বাবধান করা হয়।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment